সুদূর অতীতে গঙ্গাবাহিত পলির ক্রমসঞ্চায়নে বঙ্গোপসাগরের বুকে তিল তিল করে জেগেই যে মেহেরপুরের উৎপত্তি তাতে কারো দ্বিমত নেই। উৎপত্তির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও এর প্রাচীন ইতিহাসের বেশির ভাগই অনুদঘাটিত রয়ে গেছে। মেহেরপুরের নামকরণ বিষয়ক দু’টি মতবাদ প্রচলিত আছে।
প্রথম মতবাদটি হচ্ছে দরবেশ মেহের আলীশাহ এর নামানুসারে মেহেরপুরের নামকরণ হয়েছে। দরবেশ মেহেরআলী শাহ ১৬০৫ সালে ইয়ামেন শহরের খ্যাতিমান কোনিয়া বংশে জন্মগ্রহণকরেন। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ভারত উপমহাদেশে আসেন এবং ১৬৫৯ সালে মেহেরপুরের শেখ পাড়ায় খন্দকার ইছহাক নামীয় প্রতাপশালী ব্যক্তির বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে কালাচাঁদপুরে তার আস্তানা গাড়েন। পরে শহরের কেন্দ্রস্থলে দ্বিতীয় দরবার শরীফ নির্মাণ করেন। অনুমান করা হয় এটা ১৬৬০-৬১ সালে নির্মিত হয়েছে এবং আজও এর ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। ১৬৬৪ সালে তিনি মেহেরপুর ত্যাগ করে পাশ্ববর্তী অঞ্চলে আস্তানা গাড়েন। পূর্বে এ অঞ্চল কি নামে পরিচিত ছিল কিংবা আদৌ এর কোন নামকরণ হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।বিতীয় মতবাদটি হচ্ছে- বিখ্যাত বচনকার মিহিরের নামানুসারে মেহেরপুরের নাম করা হয়েছে। মিহির ও তার পুত্রবধু খনা ভৈরব নদীর তীরস্থ মেহেরপুর অঞ্চলে বসবাস করতেন বলে কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে। এই মিহিরের নামানুসারে মিহিরপুর এবং পরবর্তীতে অপভ্রংশ হয়ে মেহেরপুর নামের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বিশ্লেষণ করেমিহিরের মেহেরপুর অঞ্চলে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়না। তাই এই মতবাদটি সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
সপ্তম শতাব্দীর রাজা শশাংক, পাল বংশ, সেনবংশ এগুলি বাংলাদেশের প্রাচীন যুগের ইতিহাসের অতি আলোচিত নাম। মেহেরপুর এসকল রাজা ও রাজবংশের শাসনাধীনে ছিল বলে ঐতিহাসিকগণের অভিমত। লক্ষণ সেনের রাজত্ব কালে মেহেরপুরের আমদহ ও বাগোয়ান সমৃদ্ধ জনপদ ছিল বলে জানা যায়। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজীর বাংলাবিজয় থেকে শুরু করে ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী লাভের পূর্ব পর্যন্ত যে ৭৬ জন সুবেদার, নাজিম, রাজা ও নওয়াব বাংলা শাসন করেছিলেন মেহেরপুর তাদের প্রত্যেকেরই শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে মেহেরপুরের বাগোয়ানের ভবানন্দ মজুমদার কর্তৃক নদীয়া রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা মেহেরপুরের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
নবাব মুর্শীদ কুলী খাঁর আমলের শেষদিকে মেহেরপুর এলাকা তিনটি জমিদারীর অংশে বিভক্ত ছিল। মেহেরপুরের কিছু অংশ নদীয়া রাজ্যের সংগে, খোকসা-কুমারখালী এলাকা নলডাংগা রাজ্যের এবং অবশিষ্ট এলাকা নাটোর জমিদারীর অংশ ছিল। আবার অনেকে মনে করেন এ সময় মেহেরপুর যশোরের জয়দিয়ার রাজা মুকুট রায়ের অধীনে শাসিত ছিল। তবে জানা যায় যে, নবাবি আমলে নদীয়া অঞ্চল মুলতঃ নাটোরের রানী ভবানী ও টেগর স্টেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
১৭৬৫ সালে সমগ্র বাংলা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির করতলে আসলেও মেহেরপুরের ইতিহাস ভিন্নতা লাভ করেনি। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে সমগ্র কুষ্টিয়া অঞ্চল ২৬১ টি স্থায়ী জমিদারীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মেহেরপুরে জমিদারীর সংখ্যা ছিল ৮১ টি। জন এ্যান্ড ওয়াটসন কোম্পানীর নীল কনসার্ন মেদিনীপুর স্টেট ক্রয় করলে মেহেরপুর মেদিনীপুর জমিদারীর অস্তর্ভুক্ত হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৭৯৯ সালে মেহেরপুর ও গাংনী তৎকালীন নদীয়া জেলার দুটি থানা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৮৫৪ মতান্তরে ১৮৫৭ সালে মেহেরপুর নদীয়া জেলার ৫টি মহকুমার অন্যতম হিসাবে মর্যাদা লাভ করে। এ সময় মেহেরপুর, গাংনী, করিমপুর, তেহট্ট ও চাপড়া নামক পাঁচটি থানা মেহেরপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর আগে ১৮২৩ সালে মেহেরপুর থানা যশোর জেলার অংশ হিসাবে শাসিত হয়েছে। ১৮৯২-১৮৯৭ পর্যন্ত মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গার অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়।
১৭৭৭ সালে ফরাসি যুবক লুইবর্ণার বাংলায় নীল চাষের সূত্রপাত করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্রাসী বাণিজ্যনীতির সুযোগে বহু ইংরেজ অচিরেই এ দেশে এসে আশাতিরিক্ত লাভজনক নীলের কারবার চালু করে। মুনাফা লোভে উন্মত্ত নীলকররা মেহেরপুরসহ সমগ্র নদীয়া, যশোর, চবিবশ পরগনায় কৃষকদের উপর এতটাই নির্মম নির্যাতন চালায় যে, কৃষকেরা বাঁচার স্বার্থেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাবলে কুঠিয়ালরা সশস্ত্র উপায়ে সে বিদ্রোহ দমনে উদ্যত হলে কৃষকেরাও গ্রহণ করে জঙ্গি প্রস্ত্ততি, আক্রমন করে ইংরেজ কুঠি, কখনো বা দখল করে নেয়। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহ, লড়াই, সংগ্রামের মুখে বৃটিশ সরকার ‘নীল চাষ করা অথবা না করা কৃষকের ইচ্ছাধীন বিষয় বলে আইন করতে বাধ্য হয়। অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। তৎকালীন নদীয়া জেলার চৌগাছা চুয়াডাঙ্গা, শালঘর- মধুময় এই নীল বিদ্রোহের সূচনা হলে মেহেরপুর অঞ্চলের নিপীড়িত বহু কৃষকও সে বিদ্রোহে শামিল হয় এবং নিজ নিজ এলাকায় নীলকরদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে প্রবল আন্দোলন। মেহেরপুর জেলায় নীল-বিরোধের সূত্রপাত ঘটে স্থানীয় জমিদারের মাধ্যমে। প্রজাস্বার্থ বা কৃষক স্বার্থে এ বিরোধ নয়, বরং ব্যবসায়িক স্বার্থেই মেহেরপুরের জমিদার মুখুজ্যেদের সঙ্গে নিশ্চিন্তপুর কনসার্নের ধূর্ত নীলকর জেমস্ হিল- এর বিবাদ শুর হয় ঊনবিংশ শতকের একেবারে গোড়াতেই।
রেডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত বাঙ্গালির প্রতিনিধিত্বহীন বেঙ্গল রাউন্ডারি কমিশন ১৯৪৭ সালের ১৬ আগস্ট তার রিপোর্ট ঘোষণা করে। এই রিপোর্ট রেডক্লিফ রোয়েদাদ নামে সমধিক পরিচিত। এই ঘোষণা শোনার জন্য মেহেরপুরে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপুল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। মেহেরপুর শহরে তখন ছিল দুটি মাত্র রেডিও। একটি মল্লিক বাড়িতে, অপরটি বড় বাজারে সুভাস বাবুর অফিস ঘরে। ১৬ আগস্ট এ দুটি রেডিওর সামনেই জনতার ভিড় জমে যায়। রেডিও’র ঘোষণা থেকে এক সময় জানা যায়- মেহেরপুর মহকুমা ভেঙে দু টুকরো করা হয়েছে। করিমপুর ও তেহট্ট থানা থেকে গেল ভারতেই, মেহেরপুর সদর ও গাংনী থানা হলো পাকিস্থানের অংশ।
১৯৪৮ সালে কুষ্টিয়াকে পূর্ণাঙ্গ জেলা ঘোষণা করা হলেও মেহেরপুর মহকুমার মর্যাদা কর্তন করে সদর থানা হিসেবে চিহ্নিত করে চুয়াডাংগার সংগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গাংনীকে কুষ্টিয়া সদর মহকুমার সংগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর কিছুদিন পর গাংনীকে পুনরায় চুয়াডাংগার সংগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মেহেরপুর মহকুমা বিলুপ্তির পর মেহেরপুরবাসীকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ১৯৫২ সালে গভর্ণর জাকির হোসেনের সময়ে মেহেরপুর পুনরায় মহকুমার মর্যাদা ফিরে পায়।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ মেহেরপুর মহকুমাকেও বিভক্ত করেছে। পূর্বে উলিখিত ০৫টি থানার মধ্যে সদর ও গাংনী নিয়ে মেহেরপুর মহকুমা কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়, অন্যদিকে অন্য ০৩টি থানা পশ্চিম বঙ্গের অংশে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আইনানুগ বৈধতা প্রদানের জন্য আনুষ্ঠানিক সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মেহেরপুর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিকতার এক গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ও প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ অনুষ্ঠিত হয় মেহেরপুর সদর উপজেলার (বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলার) বৈদ্যনাথতলার ঐতিহাসিক আম্রকাননে। কার্যত স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রশাসন ব্যবস্থা এখান থেকেই শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে মেহেরপুর দেশের একটি মহকুমা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।
স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হয়। মেহেরপুর মহকুমায় মেহেরপুর সদর ও গাংনী থানা অন্তর্ভুক্ত থাকে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে সদর উপজেলা বিভক্ত হয়ে সদর ও মুজিবনগর উপজেলা গঠিত হয়। বর্তমানে মেহেরপুর জেলা মেহেরপুর সদর, গাংনী ও মুজিবনগর এ তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত।
তথ্যসূত্রঃ
১। মেহেরপুরের ইতিহাস -সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ।
২। মেহেপুর জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-তোজাম্মেল আযম।
৩। বাংলাপিডিয়া
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস