নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর ইতিহাস আর বাঙালির ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মেহেরপুর অঞ্চলের প্রধান অপ্রধান বেগবতী সব নদীই আজ নানাবিধ ভূ-প্রাকৃতিক কারণে নাব্যতা হারিয়ে মৌসুমী জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এতদঞ্চলের ভাগ্যবঞ্চিত, শোষিত নিপীড়িত জনগণের শোষণ-বঞ্চনা ও লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে এই সব নদীই জাগ্রত সত্তার মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
একদা শুধুমাত্র নদীপথেই ছিল সমগ্র ভূ-ভারতের সঙ্গে মেহেরপুরের যোগাযোগ। কথিত আছে ১৫৮৯ সালে মোগল সেনাপতি মানসিংহ যশোরের প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য নদীপথেই মেহেরপুরের বাগোয়ানে এসে ভবানন্দ মজুমদারের সহযোগিতা গ্রহণ করেন এবং ভেরব হয়েই যশোর যান। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এ তথ্যের সমর্থন মেলে।
"মজুন্দার সঙ্গে রঙ্গে খড়ে পার হয়ে
বাগোয়ানে মানসিংহ যান সৈন্য লয়ে।"
জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে ড. আশরাফ সিদ্দিকী জনাচ্ছেন, ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্ন্দী খাঁ নদীপথে মৃগয়ায় আসেন এই বাগোয়ান পরগনায়। দুর্যোগ কবলিত হয়ে সপরিষদ আতিথ্য গ্রহণ করেন রাজু গোয়ালিনী নামের এক নামগোত্রহীন বিধবার। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব সেই বিধবাকে দান করেন বাগোয়ান মৌজা, আর বিধবার পুত্র গোয়ালা চৌধুরী (মতান্তরে গোপাল) কে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। রাজা গোয়ালা চৌধুরী এলাকার রাস্তাঘাটের যৎকিঞ্চিৎ উন্নতি সাধন করেই পড়েন সংকটে। ঐ রাস্তা ধরেই বর্গি দুস্যুরা আসে মেহেরপুরে, লুণ্ঠন করে ধনসম্পদ, এমন কি ভূতলে আশ্রয়কক্ষ নির্মাণ করেও রক্ষা পাননি গোয়ালা চৌধুরী, বর্গিনেতা রঘুজী ভোসালার হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকেঁ।
অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ মেহেরপুরসহ সমগ্র নদীয়া যশোর অঞ্চলে নীলকরদের আগমন গঠে নদীপথেই। এ জেলার নদীতীরবর্তী দুতিনটি গ্রাম পরপর গড়ে তোলে নীলকুঠি। সাধারণ কৃষকের রক্তে-ঘামে উৎপাদিত হয় উচ্চমূল্য নীল। নদীপথেই তা চলে যায় ইংল্যান্ডে। শুষ্কপ্রায় নদীতীরের নীলকুঠির ধ্বংসবশেষেসমূহ এখান এ অঞ্চলের কৃষক সম্প্রদায়ের শোষণ-বঞ্চনা এবং লড়াই-সংগ্রামের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
দিনে দিনে কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে নদীর স্রোত। মেহেরপুর জেলার কোনো নদীকে এখন আর নদীই মনে হয়গ না। ভূ-প্রাকৃতিক নানা কারণে সব নদীই ডানা গুটিয়েছে। কেবল বর্ষাকালের অতিবর্ষণে আর বন্যার সুযোগে এই শুষ্কপ্রায় নদ নদী, খালবিল জাগ্রত এক সত্তায় উদ্ভাসিত হয়েছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগ্রাসী অগ্রযাত্রা রুখে দাড়িয়েঁছে বুকের বিস্তার দিয়ে, গড়েছে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ; এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে নদীই যেন বা হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় ফ্রন্ট। মেহেরপুরের নদীগুলোর বহুবিচিত্র বর্ণৰময় অতীয় আছে, উজ্জ্বল বর্তমান নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রধান-অপ্রধান নদ-নদীর বহু শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত হয়েছে মেহেরপুরের ওপর দিয়ে। সব নদীই আজ মৃতপ্রায়। পলি জমতে জমতে জন্ম নিয়েছে এ অঞ্চলের উর্বরা পললভূমি।
ভৈরব:
মেহেরপুর জেলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং প্রধান নদী ভৈরব। ফানডেন ব্রোক ১৬৬০ সালে তাঁর নকশায় দেখিয়েছেন-জলাঙ্গী ও চন্দরা নামে যে দুই সহোদরা প্রমত্তা পদ্মা থেকে বেরিয়ে ভাগীরথীতে মিশেছে, তারই একটি শাখা নদী জলাঙ্গী (পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত) একদা ভৈরব নামে চুয়াডাঙ্গার নিচ দিয়ে প্রবেশ করে যশোর খুলনার ভেতর দিয়ে গড়াই প্রবাহের সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। প্রকৃত পক্ষে চুয়াডাঙ্গার নিচ দিযে নয় জলাঙ্গী থেকে বেরিয়ে ভৈরব মেহেরপুরের শোলমারিতে সীমান্ত পেরিয়ে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছেছে। ড. নীহাররঞ্জন রায় 'বাংলার নদী-নদী' গ্রন্থে ভৈরব সম্পর্কে মন্তব্য করেন, মধ্যযুগের এই নদীগুলির (চন্দনা, কুমার ও ভৈরব) মধ্যে ভৈরবও ছিল অন্যতম, কিন্তু সেই ভৈরব মনণোন্মুখ। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্রের মতে, ভৈরব একটি তীর্থ নদ। এক সময় ইহা নামের অনুরূপ ভয়ঙ্কর মূর্তিতে বিরাজ করিত। সেই ভয়ঙ্কর রূপ যখন ছিল তখন ভৈরব পশ্চিম বাংলার মুরটি গ্রামের পাশ দিয়ে জঙ্গালী নদীকে প্রধান উৎসস্থল হিসেবে রেখে শোলমারি গ্রামে সীমান্ত পেরিয়ে মেহেরপুর জেলার কাথুলি, কুতুবপুর, মহাজনপুর, পিরোজপুর, দারিয়াপুর, যশোরের বারোবাজার হয়ে কুলনার রূপসার সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই ভৈরবের যৌবনদিনে নদীপথের সুবিধা পেয়েই এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে একদা খ্রিস্ট্রান মিশনারি পাদ্রিরা এসেছেন। বল্লভপুর, রতনপুর, ভবেরপাড়া প্রভৃতি গ্রামে গড়ে তুলেছেন মিশনারি প্রতিষ্ঠানসমূহে। আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি এবং নিষ্ঠুর নীলকরদের বহু নীলকুঠি ও গড়ে ওঠে ভৈরবতীরের গ্রামগুলোতেই। ভৈরব নদীতে পলি জমতে শুরু করে বহু আগে থেকেই। ১৮৭৩ সালে এ নদীর অংশ বিশেষ সংস্কারও করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে মৃতপ্রায় এ নদী ক্ষীণ একটি স্রোতধারা হয়েই বর্তমানে বিরাজ করছে। কেবল বর্ষাকালেই বেগবতী হয়ৈ ওঠে। তবে ১৯৭১ সালে ঠিক ভৈরবমূর্তি ধারণ না করলেও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে পরাক্রমশালী প্রতিরোধযোদ্ধার ভূমিকার কারণেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মুজিনগরের পবিত্রভুমিটুকু যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্তক মুক্ত রাখা সম্ভব হয়।
মাথাভাঙ্গা:
ভৈরবে পর মেহেরপুরের উল্লেখযোগ্য নদী হচ্ছে মাথাভাঙ্গা। মাথাভাঙ্গাই পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। বিচিত্র এই নদীর গতিপথ, দুচারটি গ্রাম পেরোলেই এর নাম পাল্টে যায়, স্বভাবও যায় খানিকটা বদলে। অবশ্য মেহেরপুর জেলাবাসীর সঙ্গে এ নদীর সম্পর্ক ততটা নিবিড়গ নয়, বরং বলা যায় দূর-আত্মীয়দের মতো। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার উত্তরে জলাঙ্গী নদীর উৎসমুখের প্রায় ১৬ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মা থেকে উৎসরিত হয়ে দর্শনার পাশ দিয়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে আলমডাঙ্গা স্টেশনের আট কিলোমিটার পশ্চিমে এসে কুমার ও মাথাভাঙ্গা নামে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। তারই একটি শাখার সঙ্গে মিলিত হয়েছে দৌলতপুর থানার মধ্য থেকে কাজীপুর ও মঠমুড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ছুঁয়ে বেরিয়ে আসা মাথাভাঙ্গা নদীর ধারা। এ দুটি জেলার মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র সড়কটিতে খলিশাকুন্ডি নামক স্থানে মাথাভাঙ্গা নদীর ওর স্থাপিত হয়েছে বেইলি ব্রিজ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা এই ব্রিজের ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুরের দিকে পাকবাহিনীর আগমন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সম্প্রতি এখানে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের স্থায়ী সেতু।
শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেললাইন চালু হবার পূর্বে (১৮৬২) মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কলকাতার সঙ্গে কুষ্টিয়া অঞ্চরের যোগাযোগ রক্ষিত হতো। কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা প্রভৃতি অঞ্চলের যাবতীয় নীলকর এই নদীপথেই তাদের নীল কলকাতায় পাঠাত। ব্রিটিশ আমলেই মাথাভাঙ্গা নদী নাব্যতা হারাতে থাকে। ফলে নীলকর পড়ে সংকটে। সরকারের কাছে দেনদরবার করে তারা ১৮২০ সালে মাথাভাঙ্গা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়। উইলিয়াম হান্টারের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রবিনসন এবং মে নামক দু'জন নদী সংস্কারকের ছয় বছরের প্রচেষ্টাতেও বিশেষ কোনো ফল হয়নি। দিনে দিনে পলি জমার কারণে মাথাভাঙ্গার বুক অনেকাংশে ভরাট হয়ে এলেও এ নদীর মূল প্রবাহ এখনো সামান্য গতিশীল রয়েছে।
ছেউটি:
মেহেরপুর জেলার গাংনী থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অপর একটি ছোট নদী ছেউটি। স্থানীয় মানুষ তাকে মরা গাঙও বলে। ছেউটি মূলত মাথাভাঙ্গারই একটি ক্ষীণকের শাখা। কিন্তু এ নদীর দুই মাথাই এখন মৃত। তেরাইল বিল থেকে বেরিয়ে এসে মালশাদহ, হাড়িয়াদহ, ধানখোলা, বারাদি গ্রামের পাশ দিয়ে দীনদত্তের কাছে দিয়ে মাথাভাঙ্গায় পড়েছিল ছেউটি। কিন্তু এ নদীর দক্ষিণের এই মুখটিও পলিভরাট রুদ্ধ হয়ৈ গেছে। ফলে প্রবাহমান কোনো নদীর সঙ্গেই ছেউটির আর কোনো সম্পর্ক নেই। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোননো সময়ে এই মরাগাঙে মোটেই পানি থাকে ন।
কাজলা:
গাংনী থানার আরো একটি মৃতনদী কাজলা। কাজীপুর ইউনিয়নে মাথাভাঙ্গা তেকে বেরিয়ে নপাড়া, ভাটপাড়া, সাহারবাটি, গাড়াডোব হয়ে আমঝুপিতে বাঁকবদল করে কাজলা এক সময় গিয়ে পড়েছিল ভৈরবে। কাজলা নদীর দুইপাড়ে নীলকররা গড়ে তুলেছিল অনেকগুলো নীলকুঠি। কিন্তু এই ক্ষুদ্র নদীটির নাব্যতা অনেক আগেই হারিয়ে যায়। বর্তমানে পুরো কাজলার বুকেই চাষবাদ হয়। বর্ষাকালে খাল বিলে পানি জমার মোত এখানেও পানি জমে।
স্টুয়ার্ট খাল:
গাংনী থানার ভাটপাড়ার নিচ দিয়ে প্রবাহিত একটি মরা খাল হিজলবাড়িয়া, ডোমরদহ, দুর্লভপুর, তেরাইল হয়ে বহব্বতপুর, কামারখালি, সিঁদুরকৌটা, বাদিয়াপাড়া প্রভৃতি গ্রামের মধ্য দিয়ে খলিশাকুণ্ডিতে মাথাভাঙ্গা নদীতে মিশেছে। বর্মমানে এ খালও মৃতপ্রায়। কথিত আছে ভাটপাড়া নীলকুঠির সর্বশেষ ম্যানেজার জন স্টুয়ার্ট এই খাল পুনকননের কাজ করেন বলে একে স্টুয়ার্ট খাল বলা হয়। নীল পরিবহনের স্বার্থেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এখন নীল চাষও নেই, স্রোতস্বিনী খালও নেই, কিন্তু জন স্টুয়ার্টের নামটি এলাকাবাসীর মুখে মুখে আছে।
মড়কা খাল:
স্টুয়ার্ট খালের মতোই সংক্ষিপ্ত পরিসরের মড়কা খাল গাংনী থানার সিঁদুরকৌটা গ্রামের কাছে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বেরিয়ে খাষ্টদহ বিল হয়ে শিমুলতলা, হাড়িয়াদহ হয়ে ধানখোলার কাছে এসে ছেউটি নদীর সঙ্গে মিশেছে। ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই খালে বর্ষাকাল ছাড়া পানি থাকে না। তবু অনেকেই আজো আদর করে মড়কা নদী বলে। রাইপুর গ্রামের কাছে এই মড়কা খালের ওপর একটি ব্রিজ দিয়ে গাংনী থেকে আলমডাঙ্গা পর্যন্ত সড়কপথকে সংযুক্তি করা হয়েছে।
মেহেরপুর জেলার প্রধান-অপ্রধান সব নদী আজ মৃতপ্রায়। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানবেও না-এই সব নদীও একদা স্রোতস্বিনী ছিল। দেশ-বিদেশের ছোট-বড় নৌকা, বজরা, জাহাজ সেই স্রোতে ভেসে এই জনপদে এসেছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ, সেনাপতি মানসিংহেরও এই নদীপথেই আগমন ঘটেছে বাগোয়ান। নদী নেই। স্রোতধারার গতিপরিবর্তনের সময় নদী তার নিজের অজান্তে ও অনিচ্ছায় যে সমস্ত পুরাতন খাত তৈরি করেছিল সেই সব কোল, ডামোশ বা দহতেও সারা বছর পানি থাকে না, তবু আমদহ, মালশাদহ, হাড়িয়াদহ, ভোমরদহ প্রভৃতি গ্রামগুলি তার নামের শেশে 'দহ' লেজুড়ের সঙ্গে ইতিহাসের স্রোতধারাও বয়ে চলেছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস